কারাগার আধুনিক সভ্যতায় বন্দিদের সংশোধন ও সুপ্রশিক্ষিত করে সভ্য সমাজের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার প্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন কারণে মানুষ অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়তে পারে। আইন অনুসারে শাস্তি প্রদানের পাশাপাশি তাকে সংশোধন করে গড়ে তোলার দায়িত্ব বাংলাদেশ কারা বিভাগের। “রাখিব নিরাপদ দেখাব আলোর পথ’’ এই মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে দেশের কারাগারসমূহে আগত বিপথগামী লোকদের সঠিক প্রেষণা প্রদানের মাধ্যমে তাদের কৃত ভুল বুঝতে সহায়তা করা ও সংশোধন করা এবং বর্তমান যুগের সথে তাল মিলিয়ে সঠিক প্রশিক্ষণ প্রদান করে দক্ষ মানব সম্পদ হিসেবে সমাজে ফিরিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে কারা প্রশাসন নিরলসভাবে.কাজ.করে.যাচ্ছে।
ইতিহাস :
লোক পরস্পরায় চলে আসছে ‘‘লাল দালান’’ কথাটা৷ চারপাশ ঘিরে ভারী উঁচু দেয়াল, মধ্যে লোহার গারদে আটক মানব সন্তান। তার দুঃখ-কষ্ট, ব্যথা-বেদনা আমাদের গতিময় স্বাভাবিক জীবনকে স্পর্শ করে না। বন্ধ কুঠুরীতে আত্মদহনে জ্বলে-পুড়ে কেউ হয় খাঁটি সোনা, আঁধার মানিক, আবার কেউবা ডুবে যায় অন্ধকার অতলে। প্রশ্ন কি জাগেনা একই জগতের মধ্যে চার দেয়ালে ঘেরা রহস্যময় আলাদা জগৎ কিভাবে তৈরী হল? উল্লেখ্য, একদা এ জগতের সকল অবকাঠামো লালরংয়ে মোড়া ছিল।
কারাগার বা জেলখানার উৎপত্তির সঠিক নির্ঘন্ট পাওয়া খুবই দুরূহ। ইতিহাসবেত্তাদের কাছে এ বিষয়টি এখনো উন্মোচনের অপেক্ষায়। কারা ব্যবস্থাপনার অতীত খুঁজে যেটুকু জানা যায়, ১৫৫২ সালে লন্ডনে একটি প্রাসাদ St Briget well প্রথম কারাগার হিসাবে চিহ্নিত হয়৷ রাষ্ট্রীয়, সামাজিক বিভিন্ন দিক থেকে কারাগারের উপযোগিতা উপলদ্ধি করে ১৫৯৭ সালে বৃটিশ সরকার এ ধরণের আরো কয়েকটি কারাগার প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়৷ ১৬০০ সালে লন্ডনের প্রত্যেক কাউন্টিতে কারাগার তৈরীর নির্দেশ দেয়া হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে এ কারাগার গুলোতে বন্দীদের দৈহিক পরিশ্রম ও নিয়মানুবর্তিতার দিকে দৃষ্টি দেয়া হত। তবে, অষ্টাদশ শতাদ্বীয়ান্তে ইংল্যান্ডে Gail বা জেলখানার ধারণা যথেষ্ট গুরুত্ব লাভ করে। কারণ সে সময়ে এ ধরণের Gail মৃত্যু কুঠুরী হিসাবে চিহ্নিত হচ্ছিল। প্রায় আলো বাতাসহীন ঘরে নারী পুরুষ সবাইকে একত্রে রাখা হত। ফলে অনেক মহিলা নিগৃহিত হত। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষ সোচ্চার হয়ে উঠলে এ ব্যবস্থার আশু সংস্কার করা হয়। সে সময়ে কারা সংস্কারে দারুণ অবদান ছিল জন হাওয়ার্ড নামের একজন সামাজিক ব্যক্তিত্বের। তিনি দীর্ঘ কয়েক বছর (১৭৭৩ খ্রিঃ-১৭৯০খ্রিঃ) কারাগার সমূহ পরিদর্শন করে বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে অনেক লেখা-লেখির পর কারা ব্যবস্থাপনায় বেশ কিছু পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়৷ ১৮১২ খ্রিঃ ইংল্যান্ডে প্রথম জাতীয় কারাগার Milk Bank প্রতিষ্ঠিত হয়। পঁচিশ লাখ পাউন্ড ব্যয়ে নির্মিত Milk Bank-এ তিন কিলোমিটার লম্বা বারান্দাসহ কয়েকশত প্রকোষ্ঠ ছিল, যার কাজ শুরু হয়েছিল ১৮১২ সালে এবং শেষ হয় ১৮২১ সালে।
যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীনতা লাভের পর ১৭৯০ সালে ফিলাডেলফিয়া অঙ্গরাজ্যে Wal Nut St. Jail প্রথম রাষ্ট্রীয় কারাগার হিসেবে স্থাপিত হয়। নিউইয়র্ক সিটিতে ১৭৯৬ সালে এবং মেরিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যে ১৮২৯ সালে কারাগার স্থাপিত হয়। পরবর্তীতে মেরিল্যান্ডর কারাগারে বন্দীদের জন্য স্কুল সম্পৃক্ত করা হয়। ১৮৩২ সালে জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যে স্থাপিত কারাগারে প্রথমবারের মত পুরস্কার পদ্ধতি হিসেবে বন্দীদের ভাল আচরণের জন্য মাসে ০২(দেুই) দিন জেল মওকুফ ও খারাপ আচরণের জন্য কয়েক ধরণের শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা নেয়া হয়। ১৮৩১ সালে ভারমন্ট কারাগারে স্বজনদের সাথে পএ যোগাযোগের সুযোগ দেয়া হয়।
গবেষণার অভাবে দূর অতীতে আমাদের উপমহাদেশে কারাগার ও ব্যবস্থাপনার সুনিদির্ষ্ট তথ্যের যোগান সীমিত হয়ে আছে। জানা যায়, ভারতের রাজা অশোকের সময়ে মৃত্যুদন্ডাদেশপ্রাপ্ত বন্দীকে তিন দিন একটি কুঠুরীতে বেঁধে রাখা হতো। এ ধরণের কয়েদ খানার অস্তিত্ব জমিদারী ব্যবস্থাপনায় ছিল। উপমহাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আগমনের পর মূলতঃ কারা ব্যবস্থাপনা নতুন আঙ্গিকে প্রকাশ পেতে থাকে। ১৮১৮ সালে রাজবন্দীদের আটকার্থে বেঙ্গল বিধি জারী করা হয়। বর্তমানের বাংলাদেশের ঢাকা, রাজশাহী, যশোর, কুমিল্লা এবং কয়েকটি জেলা ও মহকুমা কারাগার উক্ত সময়ে নির্মিত হয়। তবে ১৭৮৮ সালে একটি ক্রিমিনাল ওয়ার্ড নির্মাণের মাধ্যমে ঢাকা কারাগারের কাজ শুরু হয়। ১৮৬৪ সালে সকল কারাগার পরিচালনা ব্যবস্থাপনার মধ্যে এক সমন্বিত কার্যক্রম প্রতিষ্ঠিত হয় Code of rules চালুর মাধ্যমে৷ ১৯২৭ সালের এপ্রিলে কিশোরদের জন্য বাকুড়ায়(ভারত) প্রথম Borstal Institute স্থাপিত হয়। ১৯২৯ সালে অবিভক্ত বাংলায় কোলকাতার প্রেসিডেন্সি, আলীপুর, মেদিনিপুর, ঢাকা ও রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার হিসেবে ঘোষিত হয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর ০৪ টি কেন্দ্রীয় কারাগার, ১৩টি জেলা কারাগার এবং ৪৩ টি উপ-কারাগার নিয়ে বাংলাদেশ জেল(বি ডি জে) এর যাত্রা শুরু। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে বন্দী সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে উপ-কারাগার গুলিকে জেলা কারাগারে রূপান্তর করা হয়৷ বর্তমানে ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগার এবং ৫৫টি জেলা কারাগার নিয়ে বাংলাদেশ জেল কাজ করে চলছে।
কারা বিভাগ বাংলাদেশের একটি সুপ্রাচীন প্রতিষ্ঠান। ১৭৮৮ সালে তৎকালীন শাসকদের দ্বারা একটি ক্রিমিনাল ওয়ার্ড নির্মাণের মাধ্যমে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের তথা কারা বিভাগের যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তীতে ১৮১৮ সালে রাজবন্দিদের আটকার্থে বেঙ্গল বিধি জারি করা হয়। ১৮৩৬ সালে জেলা ও তৎকালীন মহকুমা সদর ঢাকা, রাজশাহী, যশোর ও কুমিল্লায় কারাগার নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীতে ১৯২৯ সালে ঢাকা ও রাজশাহী কারাগারকে কেন্দ্রীয় কারাগার হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলাদেশ জেল বা বি,ডি,জে এর যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে ১৩ টি কেন্দ্রীয় কারাগার ও ৫৫টি জেলা কারাগার রয়েছে।
প্রশাসনিক অবকাঠামো :
কারা বিভাগ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের criminal justice system এর একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কারা সদর দপ্তর, ৭টি বিভাগীয় কারা দপ্তর এবং ৬৮টি কারাগার নিয়ে বাংলাদেশের কারা বিভাগ গঠিত। কারা বিভাগের সকল কাজকর্ম কারা সদর দপ্তর থেকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়ে থাকে। কারা মহাপরিদর্শকের নেতৃত্বে ১ জন অতিঃ কারা মহাপরিদর্শক ও ৮ জন কারা উপ-মহাপরিদর্শকের সমন্বয়ে কারা বিভাগের প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। কারাগার পর্যায়ে জেল সুপার/সিনিয়র জেল সুপার দপ্তর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
ভিশন : “রাখিব নিরাপদ, দেখাব আলোর পথ’’।
মিশন : বন্দিদের নিরাপদ আটক নিশ্চিত করা, কারাগারের কঠোর নিরপত্তা ও বন্দিদের মাঝে শৃঙ্খলা বজায় রাখা, বন্দিদের সাথে মানবিক আচরণ করা, যথাযথভাবে তাদের বাসস্থান, খাদ্য, চিকিৎসা এবং আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও আইনজীবীদের সাথে সাক্ষাৎ নিশ্চিত করা এবং একজন সুনাগরিক হিসেবে সমাজে পুনর্বাসন করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় প্রেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রদান করা।